বুধবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৫

স্কুল-কলেজের ইসলামিয়াতের সিলেবাস : একটি পর্যালোচনা

আল্লাহ তাআলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। তাওহীদের বিশ্বাস অন্তরে ধারণ করে তাঁর বন্দেগী ও ফরমাবরদারীর মাধ্যমে মানব জীবনযাপন করবে এই উদ্দেশ্যেই তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা পৃথিবীকে মানুষের আবাসস্থল বানিয়েছেন এবং দুনিয়ার জীবনে আখিরাতের প্রস্ত্ততি গ্রহণের আদেশ করেছেন। তবে মানুষের জাগতিক প্রয়োজনও রয়েছে। হিকমতের কারণে আল্লাহ তাআলা মানুষকে নানাবিধ প্রয়োজনের মুখাপেক্ষী করেছেন। এই প্রয়োজন পূরণের জন্য যে জ্ঞান ও বিদ্যা আবশ্যক তাকেই আমরা বলি জাগতিক বিদ্যা। বহু শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত এই জ্ঞানের উৎস ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা।
পক্ষান্তরে যে উদ্দেশ্যে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার ইবাদত, তাঁর হুকুম-আহকাম পালন এবং আখিরাতের জীবনের প্রস্ত্ততি ইত্যাদির জন্যও জ্ঞানের প্রয়োজন। এই জ্ঞানের নাম ইলমুদ্দীন। এর মূল উৎস ওহী যা কুরআন মজীদ ও সুন্নতে নববীরূপে আমাদের মাঝে বিদ্যমান রয়েছে। ইলমুদ্দীনেরও অসংখ্য শাখা-প্রশাখা রয়েছে।
একটি অবক্ষয়মুক্ত সভ্য সমাজের জন্য দুটোরই প্রয়োজন। দ্বীনী জ্ঞান ও জাগতিক বিদ্যা দুটোই অপরিহার্য। জাগতিক বিদ্যা চর্চা বন্ধ হলে মানুষের দেহ ও মানবজীবনের বাহিরের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে আর ইলমে ওহীর চর্চা বন্ধ হলে আক্রান্ত হবে মানুষের হৃদয় ও আত্মা এবং মানবজীবনের ভিতরের অংশ। মানুষের অবয়ব থাকবে কিন্তু মনুষ্যত্বের অপমৃত্যু ঘটবে। ফলে মানুষের মধ্যেই বৃদ্ধি লাভ করবে পশুত্ব। যার একমাত্র প্রবণতা হবে পাশবিক চাহিদা পূর্ণ করা।
দুই.
আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এ এক পরীক্ষা যে, মানুষের স্বভাবের মধ্যেই পার্থিব প্রয়োজন পূরণের প্রেরণা বিদ্যমান রয়েছে। এই স্বভাবজাত প্রেরণা থেকেই মানুষ জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় আত্মনিয়োগ করে থাকে।
সম্ভবত এজন্যই জাগতিক বিদ্যাচর্চার বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহয় সরাসরি তাকিদ করা হয়নি। সাধারণ অবস্থায় একে রাখা হয়েছে মুবাহের পর্যায়ে। তবে এ বিষয়ে তাকিদ করা  হয়েছে যে, যারা জাগতিক বিদ্যা চর্চায় আত্মনিয়োগ করবে তারা যেন আল্লাহর রেযামন্দীর কাজে তা ব্যবহার করে। মানুষের দ্বীনী ও দুনিয়াবী সেবা করে এবং নিজ দায়িত্ব সুচারুরূপে সম্পন্ন করে।
 পক্ষান্তরে ইলমে ওহীর সম্পর্ক হচ্ছে এমন এক জীবনের সঙ্গে, যা দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। গাইব ও আখিরাতের প্রতি ঈমানই এই ইলমের ভিত্তি। তদ্রূপ হৃদয় ও আত্মার পরিশুদ্ধি, চরিত্র ও জীবন গঠন, ব্যক্তি সংশোধন ও সমাজ সংস্কার হচ্ছে এই ইলমের লক্ষ্য উদ্দেশ্য। যা মানব স্বভাবের জন্য অত্যন্ত কঠিন। তদ্রূপ এই ইলমের সম্পর্ক আল্লাহ ও বান্দার যাবতীয় হক আদায়ের সঙ্গে, যা স্বভাবত কঠিন। সম্ভবত এজন্যই কুরআন-হাদীসে ইলমে ওহী বা ইলমে দ্বীনের পঠন-পাঠনের ব্যাপারে জোর তাকিদ দেওয়া হয়েছে এবং এর ছওয়াব ও ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে।
তিন.
যদিও উপরোক্ত দুধরনের জ্ঞানই প্রয়োজনীয়। তবে কোনটির প্রয়োজন ও গুরুত্ব অধিক তা অনুধাবন করা চিন্তাশীলদের জন্য কঠিন নয়।
বলাবাহুল্য যে, যে ইলমের সম্পর্ক সৃষ্টির পরিবর্তে স্রষ্টার সঙ্গে, যার ভিত্তি অভিজ্ঞতার স্থলে আসমানী ওহীর উপর, যার লক্ষ্য নশ্বর জগতের স্থলে অবিনশ্বর জগত, যার বিষয়বস্ত্ত মানুষের শরীরের স্থলে তার কলব ও হৃদয় এবং যার লক্ষ্য মানুষের অবয়বের স্থলে মনুষ্যত্বের পরিচর্যা সেই ইলমই অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও উত্তম হবে। আর তা হচ্ছে ইলমে দ্বীন, যার ভিত্তি ওহী।
কিন্তু ইলমে দ্বীনের বিস্তার ও গভীরতা সম্পর্কে চিন্তা করলে প্রতীয়মান হয় যে, তা এক অথৈ সমুদ্র। তাই প্রত্যেককে পূর্ণ দ্বীনের ইলম অর্জনের আদেশ করা হলে এবং প্রত্যেকের উপর ইলমে দ্বীনের বিশেষজ্ঞ হওয়া অপরিহার্য করা হলে তা পালন করা অসম্ভব হয়ে দাড়াত। কিংবা জীবনের শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যেত। সম্ভবত এজন্যই শরীয়তে সকল বিষয়ের পূর্ণ ইলম ও বিশেষজ্ঞতা অর্জন ফরযে আইন করা হয়নি। একে করা হয়েছে ফরযে কিফায়া। অর্থাৎ প্রত্যেক মুসলিম জনপদে ইলমে দ্বীনের মাহির ও বিশেষজ্ঞ বিদ্যমান থাকলে সকলেই দায়মুক্ত হবে। তবে প্রয়োজন পরিমাণ ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরয সাব্যস্ত করা হয়েছে।
এই ফরযে আইন ইলমের মধ্যে রয়েছে ঈমানিয়াত ও আকাইদের ইলম, ফরয ইবাদতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইলম, হালাল-হারামের ইলম, ঈমানের শাখা-প্রশাখা, দৈনন্দিন প্রয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিধান, যে যে পেশায় জড়িত তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মাসাইল ও আহকাম, কুরআন মজীদের সহীহ-শুদ্ধভাবে তেলাওয়াত (যদিও তা কিছু অংশই হোক)। এই পরিমাণ ইলম অর্জন করার পর আরো অধিক ইলম অর্জন করাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। তবে তা ফরযে আইন করা হয়নি।
চার.
জ্ঞানের বিষয়ে শরীয়তের নীতি এই যে, জাগতিক জ্ঞান ও দ্বীনী ইলম দুটোই প্রয়োজনীয় এবং দুটোরই চর্চা সমাজে থাকতে হবে। তবে জাগতিক জ্ঞানকে দ্বীনী ইলমের অনুগত রাখতে হবে এবং একে ইলমে ওহীর সেবা ও সৃষ্টির সেবায় নিয়োজিত করতে হবে।
ইতিহাস সাক্ষী যে, ইসলামী খিলাফত আমলে খলীফাতুল মুসলিমীনগণ উভয় জ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। সকল শ্রেণীর নাগরিকদের মাঝে ফরযে আইন পর্যায়ের দ্বীনী ইলমের চর্চা ছিল। মুসলিম সমাজে যেমন ইলমে ওহীর বিশেষজ্ঞ বিদ্যমান ছিলেন তদ্রূপ জাগতিক বিদ্যায় পারদর্শী ব্যক্তিত্বেরও অভাব ছিল না। তবে জাগতিক বিদ্যা চর্চায় মগ্ন থাকার ফলে যদিও তারা ইলমে ওহীর পারদর্শী হতেন না কিন্তু তারা হতেন দ্বীনদার। ফরযে আইন পরিমাণ ইলম ছাড়াও আরও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তাদের ইলমে দ্বীন আত্মস্ত থাকত।
মোটকথা, শরীয়ত জাগতিক জ্ঞান অর্জনকে নাজায়েয বলে না। নাজায়েয বলে ক্ষতিকর বিদ্যাচর্চাকে। তদ্রূপ জাগতিক বিদ্যায় এ পরিমাণ মগ্নতাকেও শরীয়ত নাজায়েয বলে, যা মানুষকে আল্লাহর পরিচয় ও স্মরণ, তাঁর ইবাদত-বন্দেগী ও আদেশ-নিষেধের বিষয়ে উদাসীন করে দেয়।
শরীয়ত প্রয়োজনীয় ও উপকারী জ্ঞান অর্জনকে উৎসাহিত করেছে এবং অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর জ্ঞান চর্চা নিষিদ্ধ করেছে। শরীয়তের দৃষ্টিতে জাগতিক বিদ্যা ও দ্বীনী ইলমের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ নেই। সংঘর্ষ হল উপকারী ও ক্ষতিকর বিদ্যার মাঝে।
পাঁচ.
ব্রিটিশ বেনিয়া শক্তি ভারতীয় মুসলমানদের যে চরম ক্ষতিগুলো করেছে তার মধ্যে অন্যতম এই যে, তারা মুসলিম তরুণদের চিন্তাচেতনায় ধর্মবিমুখতা ও ধর্মদ্রোহীতার বিজ বপন করেছে। তাদের চিন্তা-চেতনায় এই ধারণা বদ্ধমূল করে দিয়েছে যে, ইলমে দ্বীন ও জাগতিক বিদ্যার মধ্যে রয়েছে অলঙ্ঘনীয় বৈপরীত্ব। ইলমে দ্বীন চর্চার অর্থই হল, জীবন ও জগত সম্পর্কে অজ্ঞতার শিকার হওয়া ...! ...!
পক্ষান্তরে জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা সম্ভবই নয় যদি না বৈষয়িক ভাবনায় সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন থাকা হয় এবং আল্লাহকে ও তাঁর ইবাদত-বন্দেগী, ইতাআত ও আনুগত্য পরিহার করা হয়!!
মুসলিম উম্মাহর দুর্ভাগ্য যে, মানবতার দুশমন খোদাদ্রোহী এ সম্প্রদায় তাদের উদ্দেশ্য হাসিলে সফল হয়েছে। তারা জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্য যা ছিল একটি প্রয়োজনীয় ও উপকারী বিষয় এমন পরিবেশ ও পাঠ্যক্রম উদ্ভাবন করেছে, যাতে আল্লাহর পরিচয় এবং তাঁর মর্যাদা ও মহববত অন্তরে সৃষ্টি হওয়ার কোনো অবকাশই থাকে না।
একই সঙ্গে বহু ক্ষতিকর বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি ঘটিয়ে বিষয়টাকে আরো জটিল করা হয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থায় এমনসব উপাদান সন্নিবেশিত হয়েছে, যার দ্বারা মুসলমানের সন্তানেরা শুধু ইসলাম থেকেই দূরে সরে যায় না; বরং তারা ধর্মদ্রোহীতা ও চারিত্রিক অবক্ষয়ের শিকার হয়ে যায়।
ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা ইংরেজদেরকে এ অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করেছি, কিন্তু ইংরেজ দাসত্ব থেকে এখনও আমরা মুক্ত হতে পারিনি।
আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থায় এখনো আমরা তাদের অন্ধ আনুগত্য বজায় রেখেছি।
ছয়.
বৃটিশ খেদাও আন্দোলনের সময় এ অঞ্চলের জনগণ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ শ্লোগানে দশদিক প্রকম্পিত করেছে। তাদের দাবি এই ছিল যে, মুসলমানদের ভিন্ন আবাসভূমি চাই যেন আমরা ইসলামের বিধান মোতাবেক জীবনযাপন করতে পারি। এর দাবি তো ছিল, এই ভূখন্ডে ইসলামী শাসনব্যবস্থা কার্যকর হবে, শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামী নীতি ও আদর্শের প্রতিফলন থাকবে এবং ফরযে আইন পরিমাণ ইলমে দ্বীন; বরং প্রয়োজনীয় আরো কিছু বিষয় সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হবে। এইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গ্রাজুয়েটরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জনের পাশাপাশি আল্লাহর অনুগত বান্দা হবে এবং খালিক ও মাখলুকের যাবতীয় হক আদায়ে সচেতন ও সচেষ্ট হবে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই আশা পূর্ণ হয়নি। শত্রুর কূট-কৌশলের কাছে এ অঞ্চলের মুসলমানরা পরাজিত হয়েছে। ফলে সেই সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থাই বহাল থাকল, উপরন্তু আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের সংস্কারের পরিবর্তে ইলমে দ্বীনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই পরামর্শ দিতে লাগল যে এই এই বিষয় সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা হোক!
দেশের নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীদের অপরিহার্য কর্তব্য ছিল, তারা নিজেরাও ইলমে দ্বীনের ব্যাপারে মনোযোগী হবেন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও দ্বীনদারী ও ইনসানিয়াতের পরিবেশ সৃষ্টি করার এবং প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ফরযে আইন পরিমাণ মানসম্মত দ্বীনী শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু এটা না করে তারা সর্বদা সমাজ ও মানবতার সেবক এই দ্বীনী মাদরাসাসমূহের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রপাগান্ডায় লিপ্ত হলেন!
সাত.
তবে এটাও গনীমত যে, তৃতীয় শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত মাত্র একটি বিষয় ইসলাম শিক্ষা নামে রাখা হয়েছে। ইসলাম শিক্ষা নামে সাতটি বই রয়েছে, নবম ও দশম শ্রেণীর জন্য একটি বই রাখা হয়েছে। বেশ কিছু দিন ধরেই আমার ইচ্ছা ছিল যে, এই বইগুলোর ভেতরের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার। কোনো কথা সংশোধনের প্রয়োজন হলে সে ব্যাপারে সতর্ক করার। এদিকে কিছুদিন আগে আমার এক বন্ধু বর্তমান সিলেবাসের এ সাতটি বইয়ের কপি পাঠিয়ে দেন এবং কাজটির জন্য বিশেষভাবে তাকিদ দেন। এ উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে আমি প্রথমে বইগুলোতে একবার চোখ বুলাই। তাতে এমন কিছু ভালো বিষয় নযরে এসেছে যা প্রকৃত পক্ষেই প্রশংসাযোগ্য। পাশাপাশি এমন কিছু বিষয় নযরে এসেছে যেগুলো সংশোধন করা একান্ত জরুরি। নিম্নে এ ব্যাপারে কিছু মৌলিক কথা বলা হল :
১. এ বইগুলোতে দ্বীনের ফরযে আইন বিষয়গুলো পুরোপুরি অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এমনকি দশম শ্রেণীতেও না।
২. এ বইগুলো পড়ার পর একজন শিক্ষার্থীর দ্বীনে ইসলাম সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ও সহীহ ধারণা কখনোই হবে না।
৩. আশ্চর্যের বিষয় এই যে, দ্বীনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক কথাও তাতে আসেনি। ঈমানের কালেমারও কোনো সুস্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা এখানে নেই। সর্বশেষ বইতেও তাওহীদ ও শিরক এবং সুন্নত ও বিদআতের স্পষ্ট কোনো পরিচয় দেওয়া হয়নি। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ দ্বীন ও শরীয়ত যার নিজস্ব তাহযীব তথা সংস্কৃতি রয়েছে। অথচ এ সম্পর্কে কোনো আলোচনা এখানে নেই। ঈমানের শাখা-প্রশাখা এবং কবীরা ও সগীরা গুনাহের কোনো তালিকাও এখানে দেওয়া হয়নি।
এছাড়া যা কিছু লেখা হয়েছে সেগুলো সহীহভাবে লেখার যথাযথ ইহতিমাম করা হয়নি। কোনো হাদীস সর্ম্পূণ সূত্রবিহীন হওয়ার পরও লেখা হয়েছে। দ্বীনী পরিভাষাসমূহের সংজ্ঞা প্রদানের ক্ষেত্রে বহু ভুল হয়েছে। কোনো কোনো বুনিয়াদী বিষয়ের পরিচয় খুবই ত্রুটিপূর্ণভাবে বা ভুলভাবে করা হয়েছে। যেমন সুদ ও ঘুষের পরিচয়ের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইবাদত-এর যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তা মূলত ইতাআত-এর সংজ্ঞা।ইবাদত যা একটি কুরআনী পরিভাষা, তার কোনো শরয়ী পারিভাষিক সংজ্ঞা কোথাও দেওয়া হয়নি। এরকম আরো ছোট বড় ভুলত্রুটি রয়ে গেছে।
এ সমস্যার কারণে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার দ্বীনিয়াত সংক্রান্ত সিলেবাসের বর্তমান এবং পূর্ববর্তী বইগুলো (যা যোগাড় করা সম্ভব হয়) শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গভীরভাবে অধ্যয়ন এবং সব ধরনের ভুল চিহ্নিত করে সেগুলো সংশোধনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। সাথে সাথে এই বিষয়কে সফল ও মানোত্তীর্ণ করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তাবনা পেশ করা প্রয়োজন। যেন ভবিষ্যতে এ বিষয়টি ত্রুটিমুক্ত হতে পারে এবং স্বীয় উদ্দেশ্যে সফল হতে পারে। আর ইতোপূর্বে যে সকল শিক্ষার্থী ঐ বইগুলোর ভুল থেকে প্রভাবিত হয়েছেন তারাও যেন সহীহ দিক-নির্দেশনা লাভ করতে পারেন। আল্লাহ তাআলা এই নেক কাজকে কবুল করুন এবং ইখলাস ও ইতকানের সাথে এই দায়িত্ব আঞ্জাম দেওয়ার তাওফীক দান করুন।
এই সংখ্যায় শুধুমাত্র জরুরি ভূমিকার উপরই ক্ষান্ত করা হল। ইনশাআল্লাহ পরবর্তী সংখ্যা থেকে ধারাবাহিকভাবে পাঠকবৃন্দ এ বিষয়ে বিস্তারিত লেখা পাবেন। যাতে কলেজ-ভার্সিটির ইসলাম শিক্ষা বিষয়ক বইগুলোর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আলোচনা ও সংশোধনীও থাকবে ইনশাআল্লাহ। 

শাসনের নীতি শাসনের নীতি শাসনের নীতি

ইসলামের সকল শিক্ষা পূর্ণাঙ্গ ও ভারসাম্যপূর্ণ এবং সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য পূর্ণ কল্যাণকর। তালীম-তরবিয়তের ক্ষেত্রেও ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ দিক-নির্দেশনা রয়েছে। তাতে যেমন নম্রতা ও সহনশীলতার নির্দেশনা আছে, তেমনি আছে শাস্তি ও শাসনের বিধান। তরবিয়তের ক্ষেত্রে শাস্তির কোনো প্রয়োজন নেই-এটা যেমন অবাস্তব কথা তেমনি শাস্তিকে তরবিয়তের প্রধান উপায় মনে করাও মূর্খতা। বস্ত্তত শাস্তি হচ্ছে ঔষধের মতো। স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য যেমন ঔষধের প্রয়োজন তেমনি তালীম-তরবিয়তের ক্ষেত্রে প্রয়োজন শাস্তি ও শাসনের। তবে একথা বলাই বাহুল্য যে, সুস্বাস্থ্যের মূল উপাদান ঔষধ নয়। সুস্বাস্থ্যের জন্য মূল উপাদান হল পুষ্টিকর খাবার, পরিমিত শরীরচর্চা, প্রয়োজনীয় বিশ্রাম ও শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপন ইত্যাদি। এরপর অসুখ-বিসুখ হলে প্রয়োজন হয় চিকিৎসা ও ঔষধ ব্যবহারের। অতএব এর প্রয়োজনীয়তা বিশেষ অবস্থার সঙ্গে সীমাবদ্ধ। আর এ ক্ষেত্রেও রোগ-নির্ণয়, ঔষধ নির্বাচন, ব্যবহারের নিয়ম ও মাত্রা  ইত্যাদির জন্য অভিজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়। তরবিয়তের ক্ষেত্রে শাস্তির বিষয়টিও এখান থেকে অনুমান করে নেওয়া যায়।
মূলপন্থা নম্রতা ও সহনশীলতা
শিশুদের ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব শাসন  এড়িয়ে চলা উচিত। ধৈর্য্য ও সহনশীলতা সঙ্গে তাকে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। যখন শাসনের প্রয়োজন হয় তখন পূর্ণ সংযম ও দূরদর্শিতার পরিচয় না দিলে শিশুর উপর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়।
আল্লামা ইবনে খালদূন রাহ. ‘‘আলমুকাদ্দিমা’’য় লিখেছেন যে, শিশুর সঙ্গে যদি অতিরিক্ত দুর্ব্যবহার ও কঠিন আচরণ করা হয় তাহলে তারা ভীরু, অলস ও পলায়নপর হয়ে যায়। তাদের উদ্যম ও প্রফুল্লতা বিনষ্ট হয়ে যায় এবং চ্যালেঞ্জ গ্রহণের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে।
শাস্তি থেকে আত্মরক্ষার জন্য তারা মিথ্যাচার ও তোষামোদ রপ্ত করে ফেলে। একসময় এগুলোই তাদের স্বভাবে পরিণত হয় এবং আত্মমর্যাদা, সৎসাহস ও উন্নত চিন্তা ইত্যাদি গুণাবলি থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। এরপর শাস্তি ও চাপের পরিবেশ থেকে মুক্তি লাভ করলেও ওই সব গুণাবলি আর তার মধ্যে সৃষ্টি হয় না।
ইমাম গাযালী রাহ. শিশুদের তরবিয়ত-সংক্রান্ত এক দীর্ঘ আলোচনায় বলেন, শিশু যখন কোনো ভালো কাজ করে তখন তাকে বাহবা দেওয়া উচিত এবং অন্যদের সামনে তাকে সম্মানিত ও পুরষ্কৃত করা উচিত। পক্ষান্তরে কখনো যদি বিপরীত কিছু দেখা যায় তাহলে তা না দেখার ভান করে এড়িয়ে যাওয়া উচিত। বিশেষত শিশু যখন নিজেই তা লুকিয়ে রাখতে সচেষ্ট। আর তাকে সর্বদা ধমক দেওয়া উচিত নয়। কেননা এতে সে ভৎর্সনা শুনতে অভ্যস্থ হয়ে উঠবে। পিতা তাকে মাঝে মাঝে ভৎর্সনা করবেন। আর মা তাকে পিতার ভয় দেখিয়ে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবেন।-ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন
শিশুর মনোদৈহিক বিকাশে তার চারপাশের পরিবেশ কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা ইবনে সীনা-র একটি বক্তব্য থেকে বোঝা যায়।
ইবনে সীনা বলেন, শিশুর স্বভাব-চরিত্রের প্রতি গভীর দৃষ্টি রাখা কর্তব্য। লক্ষ্য রাখতে হবে, তাকে যেন চরম ক্রোধ, প্রচন্ড ভীতি, কিংবা দুঃখ-বেদনা ও রাত্রি জাগরণের মুখোমুখি না হতে হয়। তার চাহিদা ও পছন্দের প্রতি লক্ষ করতে হবে যেন সেগুলো পূরণ করা যায় আর তার অপসন্দগুলোও লক্ষ করতে হবে যেন সেগুলো থেকে তাকে দূরে রাখা যায়। এর ইতিবাচক প্রভাব তার শরীর ও মন উভয় ক্ষেত্রেই পড়ে থাকে। কেননা, শিশুর মন যদি ভালো থাকে তাহলে তার স্বভাব ও আচরণও সুন্দর হবে। আর উত্তম স্বভাব ও আচরণ যেমন শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করে তেমনি মানসিক সুস্থতাও।
বলাবাহুল্য যে, উপরোক্ত মুসলিম মনীষীদের বক্তব্য সম্পূর্ণ বাস্তবসম্মত। কোনো চিন্তাশীল ব্যক্তিই এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবেন না।
আমরা যদি একদম গোড়ায় যাই এবং জগতের সর্বোত্তম শিক্ষক হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ লক্ষ করি তাহলে দেখব যে, শিশুদের সঙ্গে তাঁর আচরণ কত কোমল ছিল। হাদীস শরীফ থেকে কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে দিচ্ছি :
১. হযরত বুরায়দা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুতবা দিচ্ছিলেন। ইতিমধ্যে হাসান ও হুসাইন মসজিদে প্রবেশ করল। তাদের পরনে ছিল লাল রংয়ের জামা। তারা দৌড়ে আসছিল এবং পড়ে যাচ্ছিল।  নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন খুতবা শেষ না করেই মিম্বর থেকে নেমে এলেন এবং তাদেরকে কোলে তুলে নিলেন। এরপর বললেন, তোমাদের সম্পদ ও সন্তান তোমাদের জন্য পরীক্ষার বিষয়। আমি শিশু দুটিকে দেখলাম যে, তারা দৌড়ে আসছে এবং পড়ে যাচ্ছে। তখন আমার পক্ষে ধৈর্য্য ধারণ করা সম্ভব হল না।-জামে তিরমিযী ২/২১৮
২. হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি দীর্ঘ নামাযের ইচ্ছা নিয়ে নামায আরম্ভ করি, কিন্তু যখন কোনো শিশুর ক্রন্দনের আওয়াজ শুনি তখন নামায সংক্ষিপ্ত করে দেই। কেননা, আমি জানি, শিশুর ক্রন্দনে মার অবস্থা কেমন হয়!-সহীহ বুখারী, হাদীস ৭০৯
প্রসঙ্গত, শিশুদের তালীম-তরবিয়তের দায়িত্বে নিয়োজিত সম্মানিত উস্তাদগণের জন্য এখানে চিন্তার উপকরণ রয়েছে। শিশুদের শাসনের সময় আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণে চিন্তা করতে পারি যে, এ অবস্থাটা যদি তার মার সামনে হয় তাহলে তাঁর কেমন লাগবে?
৩. হযরত আনাস রা. কয়েকজন শিশুর নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় তাদেরকে সালাম দিলেন। এরপর বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে শিশুদের সালাম দিয়েছেন।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬২৪৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৬৮
৪. ইমাম মুসলিম রাহ. বর্ণনা করেন, লোকেরা তাদের প্রথম ফল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে নিয়ে আসত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা হাতে নিয়ে দুআ করতেন-ইয়া আল্লাহ, আমাদের ফলফলাদিতে বরকত দিন, আমাদের শহরে বরকত দিন, আমাদের ছা তে বরকত দিন, আমাদের মুদে বরকত দিন। এরপর কোনো শিশুকে ডেকে তা দিয়ে দিতেন।-সহীহ মুসলিম ১/৪৪২
শিশুদের সঙ্গে কোমল আচরণই ছিল নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ।
পরবর্তী সময়ের মনীষীগণ যতই গবেষণা করেছেন ততই তার সুফল প্রকাশিত হয়েছে। শিশুর মনোদৈহিক বিকাশে কোমল ব্যবহারের বিকল্প নেই।
এজন্য শিশুর তরবিয়তের ক্ষেত্রে মূল পন্থা হল, কোমলতা ও সহনশীলতা। যে কোনো ভুল-ত্রুটি নজরে পড়লেই শাস্তির কথা ভাবা উচিত নয়। প্রথমে ক্ষমার কথা চিন্তা করা উচিত। ইমাম নববী রাহ. বলেন, তাকে (ছাত্রকে) আপন সন্তানের মতো মমতা করবে এবং তার অন্যায় আচরণ ক্ষমা করে দিবে। কখনো কোনো বে-আদবী প্রকাশ পেলে ক্ষমা করে দিবে। কেননা, মানুষমাত্রই ভুল করে থাকে।
এরপর কোমলতার সঙ্গে সংশোধনের চেষ্টা করবে।
শিশুর মন-মানস এবং স্বভাব-প্রকৃতির দিকে লক্ষ রাখা
কখনো শাস্তির প্রয়োজন হলে ঔষধ নির্ণয়ের মতো শাস্তির ধরন ও পরিমাণ নির্ণয়ে অত্যন্ত বিচক্ষণ হতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্য ক্রোধ চরিতার্থ করা নয়; উদ্দেশ্য হল শিশুর সংশোধন। এজন্য শাস্তির বিষয়ে অত্যন্ত ধৈর্য্য ও সংযমের পরিচয় দেওয়া কর্তব্য।
সব শিশু প্রকৃতিগতভাবে এক ধরনের নয়। কেউ সামান্য তাম্বীহ দ্বারাই ঠিক হয়ে যায় আবার কাউকে শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজন হয়। কেউ শাস্তির দ্বারা সংশোধিত হয়, কেউ আরো বিগড়ে যায়। এ বিষয়গুলো আগে থেকেই পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে স্থির করা উচিত এবং যার জন্য যে পরিমাণ তাম্বীহ প্রয়োজন তার জন্য তা-ই প্রয়োগ করা উচিত।
তাম্বীহ ও শাস্তির ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রম অনুসরণ করা
অনেকে বেত ও শাস্তিকে সমার্থক মনে করে থাকেন। যেন বেত ছাড়া শাস্তির কোনো উপায় নেই। অথচ এটা হল সর্বশেষ ব্যবস্থা। পূর্বের ব্যবস্থাগুলো পরীক্ষা না করে চুড়ান্ত ব্যবস্থা প্রয়োগ করা কোনোভাবেই সমীচীন নয়।
ইবনে মাছকইুয়াহ বলেন, শিশুর প্রথম ভুল ক্ষমা করে দেওয়া উচিত। পুনরায় ওই ভুল হলে পরোক্ষভাবে তাম্বীহ করবে।  যেমন তার উপস্থিতিতে বলা হল, এই কাজ করা ঠিক নয়। কেউ যদি তা করে থাক তবে সাবধান হয়ে যাও।  এরপর সরাসরি তাম্বীহ করা যায়। এরপরও যদি ওই ভুল হয় তাহলে হালকা প্রহার করা যায়। এই সবগুলো পর্যায় অতিক্রম করার পরও যদি দেখা যায় সে সংশোধিত হয়নি তাহলে কিছুদিন তাকে আর কিছু বলবে না। এরপর আবার প্রথম থেকে আরম্ভ করবে।
এ প্রসঙ্গে তিনি ইমাম মাওয়ারদী রাহ.-এর একটি নির্দেশনা উল্লেখ করেছেন। তা এই যে, শিশুকে সংশোধন করা মুরববীর জন্য কঠিন হয়ে গেলে এবং অব্যাহত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তার মধ্যে আনুগত্য সৃষ্টি না হলে করণীয় হচ্ছে কিছু সময় তাকে অবকাশ দেওয়া। এরপর নতুনভাবে প্রচেষ্টা আরম্ভ করা।-আততারবিয়াতু ওয়াত তালীম ফিলফিকরিল ইসলামী 

মুসলিম বোনদের প্রতি খোলা চিঠি

প্রিয় বোন, বিশ্বাস কর তোমার সমালোচনা করা আমার অভিপ্রায় নয়। তোমাকে মন্দ ঠাওরানোতেও কোনো লাভ নেই আমার। পর্দা মেনে চল বা না চল, যেহেতু তোমার মাঝে ঈমান আছে তাই তুমি আমার বোন। গোড়ায় আমাদের বাবা ও মা অভিন্ন। আমাদের বিশ্বাস ও আদর্শ অভিন্ন। যে দেশ বা যে ধর্মেরই হও না কেন আদি পিতার এ সম্পর্ক নস্যাৎ করে সাধ্য কার? আমার মিনতি, কথাগুলোর ওপর একবার চোখ বুলাও। একটুখানি ভেবে দেখ খোলা মনে।
ভেবো না পৃথিবী আজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সাফল্য ও সমৃদ্ধির শীর্ষ চূড়ায় উপনীত হয়েছে। ধুলির ধরা ছাড়িয়ে মানুষ এখন পৌঁছে গেছে নানা গ্রহে-উপগ্রহে। সারা বিশ্ব এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। সুতরাং এখন পর্দা করা মানে মধ্যযুগে ফিরে যাওয়া! পর্দা করা মানে নিজেকে বঞ্চিত করা! আমাদের মুক্তি নারী স্বাধীনতায়! মুক্তি ইসলাম উপেক্ষায়!
ইতিহাস পড়ে দেখ, ইসলামই সর্বপ্রথম নারীকে মুক্তি দিয়েছে। নারীকে ভোগের পণ্য হতে দেয়নি শান্তির ধর্ম ইসলাম। একমাত্র ইসলামই কন্যা সন্তান প্রতিপালনে পুরষ্কার ঘোষণা করেছে। ইসলামই পুরুষের চারিত্রিক শুচিতা যাচাইয়ে স্ত্রীর সাক্ষ্যের কথা বলেছে। ইসলামে কোনো সুযোগ রাখা হয়নি মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে বউ নিয়ে সুখে থাকার অথবা জন্মের পর থেকে নিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত কোনো পর্বে মাকে অবমূল্যায়ন করার। স্ত্রী, কন্যা ও মাতা-নারী জীবন তো এর বাইরে নয়। এ ক্ষেত্রত্রয়ের কোনোটিতেই ইসলামের চেয়ে বেশি দিতে পারেনি কোনো ধর্ম বা কোনো জাতি।
আমার ভার্সিটিপড়ুয়া কিংবা কর্মজীবী বোন, তুমি পাশ্চাত্যের মেকি স্বাধীনতায় প্রবঞ্চিত হয়ো না। স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর হৃদয়কাড়া চিত্র দেখে ধোঁকায় পড়ো না। নাটক-সিনেমা আর ইউরোপ-আমেরিকার সুখের ছবি দেখে নিজেকে হতভাগী ভেবো না। পশ্চিমা সমাজের একটু ভেতরের খবর নিলেই জানতে পারবে বাস্তব অবস্থা।
যারা নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ে তাদের জিজ্ঞেস করে দেখ-প্রায়ই পত্রিকায় সংবাদ আসছে পশ্চিমা তরুণীরা স্বাধীনতার (!) শেকলে হাঁফিয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে ইসলাম গ্রহণের হার সবচেয়ে বেশি। উধঁমযঃবৎ ড়ভ ধহড়ঃযবৎ নামক একটি বইয়ে (কয়েক বছর আগে ঢাকা থেকে অন্যপথের কন্যারা নামে বইটির অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে) চল্লিশজন মার্কিন তরুণীর কথিত নারী স্বাধীনতা পরিহার করে পর্দার ধর্ম ইসলামে আগমনের ইতিবৃত্ত তুলে ধরা হয়েছে। তারা সবাই নারী স্বাধীনতার স্বরূপ প্রত্যক্ষ করেছেন। এ স্বাধীনতাকে তারা কৃত্রিমতা ও প্রবঞ্চনা এবং ইসলামের পর্দার বিধানকে মুক্তি ও সুরক্ষা বলে আখ্যায়িত করেছেন। বৃটেনের সান ডে এক্সপ্রেস পত্রিকার মহিলা সাংবাদিক রিডলি-যিনি আফগানিস্তানে বোরখা সম্পর্কে তালেবানদের ভূমিকার কঠোর সমালোচক ছিলেন তিনিই কিন্তু পরবর্তীতে সংবাদ সম্মেলন করে ইসলামের পর্দার ছায়াকে শান্তির ঠিকানা বানিয়ে নিয়েছেন। ভারতে খোলামেলা লেখালেখির জন্য আলোচিত মালায়াম ও ইংরেজি ভাষার লেখিকা কমলা দাস এখন ইসলাম গ্রহণ করে পর্দা করছেন। এমন নজির একটি দুটি নয় অনেক। এদের সবাই সুশিক্ষিতা। এরা কেউ আবেগের বশে বা চাপে পড়ে ইসলাম কবুল করেননি।
উচ্চাভিলাষী বোন আমার, ইসলামের সীমানায় থেকে তুমি সবই করতে পার। যদি পড়তে চাও তবে যত ইচ্ছে পড়তে পার। প্রয়োজন হলে কর্মজীবী হয়ে কাজও করতে পার। শুধু পর্দা লঙ্ঘন করো না। শরীয়তের গন্ডি অতিক্রম করো না। মনে রেখো, ইসলাম তোমার অগ্রযাত্রায় বাধা নয়। পর্দাও অন্তরায় নয় প্রগতির পথে। ইসলাম চায় তুমি যেখানেই থাক তোমার সতীত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব এবং সম্মান রক্ষা হোক। তোমার কোমলতা, সৌন্দর্য এবং ভদ্রতা বজায় থাকুক। ইসলাম তোমাকে বন্দী করতে ইচ্ছুক নয়। কোনো চরিত্রহীন যেন তোমাকে কলংকিত না করতে পারে, ছলে-বলে-কৌশলে তোমাকে অপমানিত না করতে পারে-এই ইসলামের অন্বেষা।
আমার স্কুল-কলেজগামী বোন, বখাটেদের ইভটিজিং থেকে বাঁচতে চাও? এসো পর্দার আশ্রয়ে। অমানুষদের এসিড সন্ত্রাস থেকে বাঁচতে চাইলেও এসো পর্দার নিরাপত্তায়। যৌতুক তোমাকে দিতে হবে না; বরং নগদ মোহরানা দিয়ে তোমাকে নিয়ে যেতে বাধ্য হবে যদি তুমি হিজাবে সুশোভিত হও। এ আমার দাবি নয়; বাস্তবতা। পরিসংখ্যান দেখলেই জানতে পারবে পর্দানশীনদের অল্পজনই এসব অমানবিকতার শিকার হয়।
বোন, আধুনিকতার নামে তুমি নিজেকে অসম্মান ও অনিরাপদ করো না। হেদায়েতের আলোক বঞ্চিতদের প্রচার-প্রোপাগান্ডায় বিভ্রান্ত হয়ো না। ওরা বুঝাতে চায়, সভ্যতা ও বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উৎকর্ষের এই যুগে আবার ধর্ম কেন? সভ্যতাগর্বী এসব মানুষের অপপ্রচারে তুমি প্রভাবিত হয়ো না। ওরা জানে না এর আগেও পৃথিবীতে তাদের মতো সভ্যতাগর্বী জাতি ছিল। তারা আজ কোথায়? বল, তাজ মহল এবং পিরামিড যারা গড়েছে তাদের কেউ কি পৃথিবীতে বেঁচে আছে? দয়াময় আল্লাহ কত সুন্দর করে ইরশাদ করেছেন-অর্থ: তারা কি ভ্রমণ করেনি, তাহলে তারা দেখতে, পূর্ববর্তীদের পরিণাম কেমন হয়েছিল? তারা পৃথিবীতে ছিল তাদের চেয়ে সংখ্যায় অধিক। আর শক্তিতে ও কীর্তিতে তাদের চেয়ে অধিক প্রবল। অতঃপর তারা যা অর্জন করত তা তাদের কাজে আসেনি। (সূরা মুমিন : ৮২)
প্রিয় বোন, তুমি কি জান বেপর্দার কুফল কী? পর্দার প্রতি যত অবহেলা করা হচ্ছে নারীর প্রতি সহিংসতা ততই বাড়ছে। জাতি হিসেবে আজ আমরা আগের চেয়ে বেশি শিক্ষিত। কিন্তু নারীর প্রতি সামাজিক অনাচার বেড়েছে না কমেছে? নিত্যনতুন পন্থায় নারীর উপর নির্যাতন করা হচ্ছে। পর্দা লঙ্ঘনই  অবৈধ যৌন সম্পর্কের প্রথম ধাপ আর এই অবৈধ মেলামেশাই যে নিশ্চিত মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে  আসে, এইডস-এর মতো নানা রোগ ডেকে আনে, তা বোঝার জন্য তো মুসলিম হওয়ারও প্রয়োজন নেই।
অতএব এসো মুক্তির পতাকাতলে। নিরাপত্তার সুরক্ষিত গন্ডিতে। পর্দা শুধু তোমার ইহকালীন জীবনকে নিরাপদই করবে না, নিশ্চিত করবে তোমার সম্মান ও সমৃদ্ধি। আর আখিরাতে নাজাত পাবে তুমি জাহান্নামের কল্পনাতীত শাস্তি থেকে। চিরশান্তির ঠিকানা জান্নাত হবে তোমার আবাস।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দিন। আমীন।

উম্মাহ : গুয়ানতানামো, সাবেরি আর সোয়াত কোথায় আমেরিকা কী করছে?

বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জনাব বারাক হোসেন ওবামা নির্বাচনের আগে ঘোষণা করেছিলেন তিনি বিজয়ী হলে গুয়ানতানামো কারাগার বন্ধ করে দেবেন। সন্ত্রাসের অভিযোগে ধৃত মুসলমানদের ওপর অমানবিক অত্যাচার চালিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার ধারা থামিয়ে দেবেন। সর্বোপরি মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। বিজয়ের পর চারটি মাস অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে তার প্রতিশ্রুতি পূরণের কোনো নজির দেখা যায়নি। তার কথাবার্তায় পূর্বসূরী নির্লজ্জ ব্যক্তিটির পরিবর্তে কিছু সৌজন্য ও কূটনৈতিক আবরণের নমুনা পাওয়া গেলেও বাস্তবে কোনো নতুন উদ্যোগের আলামত লক্ষ করার সুযোগ পাওয়া যায়নি। উপরন্তু গুয়ানতানামোতে বন্দীদের ওপর  অমানবিক নির্যাতনের ব্যাপারে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ডোনাল্ড রামসফেল্ডসহ যারা অনুমোদন দিয়েছিলেন তাদেরকে কোনো শাস্তি না দেওয়ার ঘোষণা তিনি দিয়েছেন এই মধ্য এপ্রিলে। এসব অত্যাচারমূলক জিজ্ঞাসাবাদ-কলা-কৌশল বন্ধের মৌখিক উদ্যোগ-ইশারার কথা ব্যক্ত হলেও এর সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে কোনো শাস্তিমূলক উদ্যোগের কথা জানানো হয়নি।
নাইন ইলেভেনের পর আফগানিস্তান-ইরাক, পাকিস্তান এবং অপরাপর দেশ থেকে মার্কিন আগ্রাসনবিরোধী মুসলমানদের ধরে নিয়ে কিউবার গুয়ানতানামো দ্বীপে অবস্থিত কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। বিনা বিচারে তাদের আটকে রাখা হয়। পানিতে চুবিয়ে রাখা, কুকুর লেলিয়ে দেওয়া, উলঙ্গ করে রাখা, ইলেক্ট্রনিক শক দেওয়া, ধর্মীয় অবমাননা করাসহ বিভিন্নভাবে সেই মুসলিম বন্দীদের ওপর যে সব অত্যাচার চালানো হতো মার্কিন নিয়ন্ত্রণাধীন মানবাধিকার সংগঠনগুলোই সেগুলোকে অমানবিক ও বর্বরোচিত বলে আখ্যায়িত করে আসছিল। মার্কিনীদের স্বার্থ আর নিষ্ঠুরতার পক্ষে ঐক্যের জোর এতটাই যে, একজন ওবামার প্রতিশ্রুতির মূল্য সেখানে কিছুই না বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। অথচ বিপরীত একটি নমুনা দেখুন। গত এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে মার্কিন নাগরিক রোখসানা সাবেরি নামের একজনকে ইরানের একটি আদালত সে দেশের কারাগারে নিক্ষেপ করেছে। সাংবাদিক পরিচয়ে ইরানে এসে ওই মহিলা গোয়েন্দাবৃত্তিতে নিয়োজিত ছিল বলে আদালতের কাছে প্রমাণিত হওয়ায় আদালাত তাকে শাস্তি দিয়েছে। এতেই আমেরিকার প্রতিক্রিয়া হয়েছে মারাত্মক। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, সাবেরিকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট সাবেরির পক্ষে আত্মপক্ষ সমর্থন ও সব আইনী পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ দিতে ইরানের ওই আদালতের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। এখনো জিজ্ঞাসাবাদের নামে তার ওপর কোনো অত্যাচার চালানো হয়নি। সাবেরির পিতা তার সন্তানের সঙ্গে দেখা করে সাংবাদিকদের বলেছেন, তার মেয়ে ভালো আছে। তারপরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জনাব বারাক ওবামা তার দেশের একজন নাগরিককে গ্রেফতার করায় দুঃখপ্রকাশ করেছেন। বলা হচ্ছে, টানাপোড়েন চলতে থাকা ইরানের সঙ্গে এ কারণে মার্কিনীদের সম্পর্ক আরো খারাপ হতে পারে।
অর্থাৎ বিষয়টি দাঁড়াল এই যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট ইচ্ছা করলে পৃথিবীর যে কোনো দেশের (যদি মুসলিম দেশ হয় তাহলে তো কথাই নেই) যে কোনো নাগরিককে দোষ প্রমাণিত না হলেও ধরে নিয়ে যে কোনো দ্বীপের জিন্দানখানায় বন্দী করে বর্বরোচিত আচরণ চালিয়ে যেতে পারবে। তাতে কোথাও কোনো সমস্যা হবে না, কিন্তু তার কোনো নাগরিককে দেশবিরোধী নির্দিষ্ট অপরাধে ধরে জেলে দিলে তাতে আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্কে প্রভাব সৃষ্টি করবে। এক দিকে পৃথিবীর সব দরিদ্র মুসলিম মানুষের মূল্য। আরেকদিকে যে কোনো মার্কিন নাগরিকের মূল্য, যা সবার চেয়েও বেশি। এ ধরনের অসাম্য ও জোর যার ... নীতি অনুসরণ করে পৃথিবীতে নতুন উদ্যোগ আর নতুন যুগের সূচনা সম্ভব নয়। মার্কিনীদের নীতি হচ্ছে, অন্য যে কাউকে আমরা অপরাধী বলে সন্দেহ করলেই সে অপরাধী আর আমাদের কেউ অপরাধ করে ধরা পড়লেও তার দিকে কেউ আঙুল উঠাতে পারবে না। এতবড় মানবিক অসাম্য নিয়ে দুনিয়া কি স্থির ও শান্ত থাকতে পারে? অপরদিকে পাকিস্তানে আবারো শরীয়া আইন বাস্তবায়ন-পন্থীদের ব্যাপারে মার্কিনীদের রাগ-ক্ষোভ প্রকাশ্য হয়ে ওঠেছে। সোয়াতে কেন শান্তিচুক্তি করা হল, কেন সেখানে শরীয়া আইন বলবৎ করার সুযোগ দেওয়া হল এ নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন প্রকাশ্যে উষ্মা প্রকাশ করেছেন।
গত ২৩ এপ্রিল এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তান ক্রমেই বিশ্বের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তিনি তালেবানদের ব্যাপারে সরকারের নীতিমালার সমালোচনা করে বলেন, চরমপন্থীদের প্রতি সরকারের নমনীয় মনোভাবের কারণে তারা ক্রমেই একটার পর একটা এলাকায় নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারছে। সোয়াতে তালেবানদের সঙ্গে সরকারের চুক্তির বিরোধিতা করার জন্য তিনি পাকিস্তান সরকারের কর্মচারী এবং জনগণের প্রতি আহবান জানান।

মূলত ইসলামাবাদের ১০০ কিলোমিটার দূরত্বের ভেতরে অবস্থিত বুনার জেলায় তালেবানরা তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই বক্তব্যটি দিয়েছেন। তার বক্তব্যে মনে হতে পারে-পাকিস্তানের তালেবানরা সোয়াতের পর বুনারে কোনো অমানবিক আইনের প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু বাস্তবে এটাকে সত্য বলে মনে করা যাচ্ছে না। জনগণ তাদের ন্যায়ানুগ শাসনকে অভিনন্দন জানালেও কেবল আমেরিকার ধমকে পাক আর্মির উদ্যোগে তারা শেষ পর্যন্ত বুনার জেলা ত্যাগ করেন। কেবল শরীয়া আইনের বাস্তবায়নকে যারা সন্ত্রাসবাদ বলে অভিহিত করেন তারাই যখন দুনিয়ার নিয়ন্ত্রক শক্তিতে পরিণত হন তখন সত্যকে এভাবেই মিথ্যা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়।

একটি ভিত্তিহীন রসম বা ভিত্তিহীন বর্ণনা : আসরের পর কিছু খাওয়া কি অনুত্তম

একজন বুদ্ধিমান শিক্ষিত মানুষের নিকট থেকে একথাটা শুনে খুবই আশ্চর্যান্বিত হয়েছি যেতিনিআসর থেকে মাগরিবের মধ্যে কিছু খান না। পূর্ব থেকেই তার ধারণা যেএই সময় খাওয়া-দাওয়াকরা ভালো না বা নিষেধ আছে।
এই ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। শরীয়তে শুধু রোযার হালতে খাওয়া-দাওয়া নিষেধ। অন্য সময় নিষেধনয়। তবে কেউ যদি বিশেষ কোনো সমস্যার কারণে বা চিকিৎসকের পরামর্শে বিশেষ কোনো সময়খাওয়া থেকে বিরত থাকে তবে সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু মনগড়াভাবে দিনে রাতের কোনোঅংশের ব্যাপারে একথা বলা যে সময় খানাপিনা থেকে বিরত থাকা উত্তম বা ছওয়াবের কাজ,সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।  ধরনের রসম-রেওয়াজ মেনে চলা শরীয়তে নিষেধ। কারো প্রয়োজন না হলেখাবে না কিন্তু একে একটি বিধান বানিয়ে দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। 





না রী : নিরাপত্তার জন্য আইন


নারীদের প্রতি যৌন হয়রানি বা নির্যাতন বন্ধে হাইকোর্ট গত ১৪ মে বৃহস্পতিবার একটি রায় দিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র এবং চলার পথসহ বিভিন্ন স্থানে নারীদের প্রতি না করার মতো কিছু আচরণ ও আচরণধারা উল্লেখ করে ওই রায়ে বলা হয়েছে এসব আচরণ করা হলে তা যৌন নির্যাতন বলে সাব্যস্ত হবে। বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দীকীর সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ যৌন হয়রানি রোধে একটি নীতিমালা তৈরি করতে এই রায় দেন। এ বিষয়ে সংসদে কোনো আইন তৈরি না হওয়া পর্যন্ত হাইকোর্ট বিভাগের এই রায়টিকেই আইনের ন্যায় বাধ্যতামূলক মেনে চলতে বলা হয়েছে। ওই রায়ে বলা হয়েছে, অচেনা মেয়েকে সুন্দরী বলা যাবে না। তাদের দিকে তাকিয়ে থাকা যাবে না। ই-মেইল বা ফোনে মেয়েদের বিরক্ত করা যাবে না। মেয়েদের উত্যক্ত করা যাবে না। তাদের উদ্দেশ করে উস্কানিমূলক কথা বলা যাবে না। কর্মক্ষেত্রে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করা যাবে না। ইঙ্গিতপূর্ণ কিছুও করা যাবে না। কর্মক্ষেত্রে নারীদের যৌন হয়রানির অভিযোগ তদন্ত করার জন্য ৩ সদস্যের একটি কমিটি থাকবে, যার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য হবেন নারী।
নারীর অধিকার ও নিরাপত্তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের মতো আইনী পদক্ষেপ অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। হাইকোর্ট বিভাগ সমাজের ভেতর থেকে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি বন্ধে যে ইতিবাচক মানসিকতার নজির রেখেছেন সুস্থ চিন্তার সব মানুষ এর সুফল কামনা করেন। নারী আর পুরুষের মাঝে চিরায়ত যে ব্যবধান ও দুর্বলতার মাত্রা বিদ্যমান সেই গভীর বাস্তবতাটি এই রায়ে কিছুটা হলেও ফুটে ওঠেছে। এটিও এই রায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যারা সকল ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মাঝে প্রয়োজনীয় সব আড়াল ও ব্যবধানের আবরণ খুলে দিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক সঙ্গে কাজ করা ও চলার মধ্যে কোনো সমস্যা দেখতেই পান না, তারা এই রায়টি ঘোষণার কারণ ও রায়টির আদ্যান্ত বিশ্লেষণ করে একটু দেখতে পারেন। এতে তারা তাদের চিন্তার ত্রুটিটা ধরতে পারবেন। দ্বিতীয়ত নারীর প্রতি বহিরাঙ্গনে যেসব যৌন হয়রানিমূলক আচরণ হয় অথবা হওয়ার আশংকা থাকে, ভেতর থেকে তার কার্যকারণগুলো নিয়েও ভাবা দরকার। পরিবেশের সব ক্ষেত্র ও আয়োজনে নারীর আকর্ষক রূপ-সৌন্দর্য্যের পসরা সাজিয়ে রেখে নারীর মর্যাদাকে অসমীচীন আঁচড়ের উর্ধ্বে রাখা কতটা সম্ভব এটাও দেখা দরকার। মিডিয়া, ফিল্ম, স্যাটেলাইট চ্যানেল, বিলবোর্ড, ম্যাগাজিন, পত্রপত্রিকা, ফ্যাশন ও প্রত্যক্ষ বিচরণ ক্ষেত্রে নারীর সৌন্দর্য্যকে আকর্ষক ও উত্তেজক করে পরিবেশন করা হতে থাকবে আর নারীকে কেবল আইন করে সব রকম বিড়ম্বনা ও হয়রানি থেকে মুক্ত রাখা যাবে-এটা মনে হয় বাস্তবানুগ চিন্তা নয়। হাইকোর্টের রায় সমাজের সামনে একটি সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এ সিদ্ধান্তের ভেতর-বাহির, বাস্তবতা-কার্যকারণ সব তলিয়ে দেখে সমাজপতি ও সমাজনিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলো আরো বড় রকম করণীয় ঠিক করে নিতে পারেন। তাতে নারী অনেক উপকৃত হবে, সমাজও সুস্থ থাকবে। হিজাব বা পর্দার মাঝে নারীর নিরাপত্তার জন্য কত বড় মন্ত্র যে লুকিয়ে আছে অনুশীলনকারীরাই কেবল তা বুঝতে পারেন। মূলত নারীর জন্য পর্দার ব্যবস্থা না করে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আর কোটি টাকার ক্যাশ পথের ওপর খোলা রেখে দিয়ে তা সংরক্ষিত থাকার চিন্তা করা সমান পর্যায়ের বিষয়।