বুধবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৫

আধুনিক সমাজে নারীর স্থান

বর্তমান সমাজ-ব্যবস্থায় নারী বিবেচিত শুধু একটি ভোগের বস্তু হিসেবে। এ বিষয়ে শিক্ষিত-অশিক্ষিতের মাঝে কোনো প্রভেদ ও মতভেদ নেই। আধুনিক সমাজের গর্বিত সদস্যগণ মুখে মুখে নারীর মর্যাদা ও অধিকারের কথা বললেও বাস্তবক্ষেত্রে উপরোক্ত বিশ্বাসেরই প্রতিফলন ঘটিয়ে থাকেন। দৈনিক পত্রিকার পাতা থেকে কিছু দৃষ্টান্ত  তুলে ধরছি।
ঘটনা : ১. গত ১১ আগস্ট     বুধবার র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ানের সদস্যরা রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে গ্রেফতার করেছে। র‌্যাব-৯ শ্রীমঙ্গল-ক্যাম্পের কমাণ্ডার কাওসার মাহমুদ জানিয়েছেনঐ শিক্ষক বিয়ের প্রলোভন দিয়ে একজন তরুণীর সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে এবং গোপন ক্যামেরায় সে দৃশ্য ধারণ করে। এরপরের কথা বলাইবাহুল্য। একপর্যায়ে সে বিদেশে পিএইচডি করতে যাওয়ার কথা বলে মেয়েটির কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে এবং টাকা দিতে ব্যর্থ হলে ধারণকৃত ভিডিওচিত্র বাজারজাত করা হবে বলে হুমকি দেয়। নিরুপায় হয়ে মেয়েটি মামলা দায়ের করলে ঐ শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয় এবং তার বাসার কম্পিউটার থেকে ঐসব ছবি ও ভিডিওচিত্র উদ্ধার করা হয়।    
মামলা দায়ের প্রসঙ্গে মেয়েটি বলেছে যেআর কোনো মেয়ে যাতে এই ব্যক্তির দ্বারা প্রতারিত না হয় এজন্য মামলা দায়ের করেছি। (দৈনিক আমাদের সময়১৩ আগস্টশুক্রবার)
ঘটনার শিকার মেয়েটি তো মূর্খ বা অসচেতন নয়। তাহলে কেন সে প্রতারিত হলতদ্রূপ প্রতারকও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো কোনো ভাসমান বখাটে নয়তিনি রাজধানীর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রতিষ্ঠিত শিক্ষকঅতএব শিক্ষিত। সঙ্গত কারণেই এই প্রশ্ন কি এসে যায় না যেপ্রচলিত শিক্ষা আমাদের কী দান করছে?
একই পত্রিকার পার্শ্ববর্তী শিরোনামটি এই -শিক্ষদের রিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ বাড়ছে,প্রয়োজন নৈতিক শোধন। পূর্ণ আলোচনা হুবহু তুলে দিচ্ছি।
‘‘সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ বেড়েই চলছে। এতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের শিক্ষকদের প্রতি বিরূপ মনোভাব তৈরি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
‘‘বিশিষ্ট দার্শনিক অধ্যাপক ড. আমিনুল ইসলাম বলেনদেশের সর্বত্র অবক্ষয়ের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা এসব কাজে জড়িয়ে পড়ছে। তবে তিনি শিক্ষকদেরকে শিক্ষার্থীদের বন্ধুদিশারী এবং দার্শনিক আখ্যায়িত করে নৈতিকতাকে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তদন্তকমিটি গঠন করে কিংবা শিক্ষকদের শাসি- দিয়ে এ অভিযোগ কমবে নানৈতিকতার ভিত্তিতে শিক্ষকদের মনমানসিকতার পরিবর্তন হলেই এ সমস্যার সমাধান হতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
‘‘গত বছরের এপ্রিল মাসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের          আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ... এর বিরুদ্ধে যৌনহয়রানির অভিযোগে বিভাগের একাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
‘‘এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ... এর বিরুদ্ধে এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ... বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনা হয়।
‘‘গত সোমবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ... কে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।
‘‘একই দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ... এর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছে একই বিভাগের এক ছাত্রী। গত বুধবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ... এর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করে একই বিভাগের এক ছাত্রী।
‘‘একই দিনে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার চন্দনপুর ইউনাইটেড কলেজের ইসলামের ইতিহাসের শিক্ষক ... এর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগে কলারোয়া থানায় মামলা হয়েছে।’’
ঘটনা : ২. ঢাকা শিশুহাসপাতালের সামনে বখাটেদের জমজমাট আড্ডা। হাসপাতালে আসা-যাওয়ার পথে তরুণী-মায়েরা প্রতিনিয়ত টিজিংয়ের শিকার হচ্ছেন। একাধিক মা জানিয়েছেন যেবখাটেদের দৌরাত্মে অতিষ্ঠ হয়ে তাঁরা অন্যত্র শিশুর চিকিৎসা করাবেন বলে মনস্থ করেছেন। (আমার দেশ২৪ আগস্ট ১০)
ইভটিজিং এখন প্রতিকারবিহীন সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বলাবাহুল্য যেএটি তরুণপ্রজন্মের ব্যাপক অধঃপতনের একটি উদ্বেগজনক উপসর্গ। বিষয়টির প্রতিকার নিয়ে কিছু চিন্তা-ভাবনা এবং অনেক লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু  উদ্বেগের বিষয় কিছু এই যেআমাদের সম্মানিত চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবীগণ       পূর্ব সংস্কারবশত সমস্যার গোড়ায় দৃষ্টি দিতে নারাজ। অন্যদিকে আমাদের আইন্তশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা বিত্তহীন মানুষের সমস্যায় কর্ণপাত করতে অনাগ্রহী।
ঘটনা : ৩. আইরিন আক্তার (২২) একজন গার্মেন্ট-কর্মী। মিরপুরের একটি গার্মেন্টে কাজ করার সময় এক সহকর্মী তাকে উত্যক্ত করত। তাই মিরপুরের চাকরি ছেড়ে দিয়ে সে আদমজীর একটি গার্মেন্টে চাকুরি নিয়েছিল। এদিকে ঐ সহকর্মীও বিভিন্নভাবে খোঁজাখুজি করে আদমজীর ঐ গার্মেন্টে চাকুরি নেয় এবং মেয়েটিকে বিরক্ত করতে থাকে। গত ৪ মে আইরিন বাদী হয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি জিডি করলেও পুলিশ কোনো ব্যবস্থানেয়নি। গত ২২ আগস্ট সকালে ঐ সহকর্মী আইরিনের বাসায় গিয়ে তাকে না পেয়ে তার বোনকে মারধর করে। থানায় জানানো হলেও পুলিশ তাতে কর্ণপাত করেনি। নিরুপায় হয়ে আইরিন বাসায় ফেরে এবং গলায় ওড়না পেঁচিয়ে সিলিং-ফ্যানের সাথে ঝুলে পড়ে। কিন্তু ভাগ্য ভালো যেপ্রতিবেশীরা টের পেয়ে দ্রুত ছুটে এসেছিলফলে সে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যায়। ঘটনাটি নিয়ে এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। (আমার দেশ২৩ আগস্টপৃ. ২)
মেয়েটিকে ভাগ্যবতী বলতে হয় আরো একটি কারণে। তা এই যেতাকে পুলিশের প্রতিহিংসার শিকার হতে হয়নি। আমাদের দেশের আইন্তশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে নারীর উপরও কতখানি নির্মম হতে পারে তার কিছু দৃষ্টান্ত পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যাবে। একটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
ঘটনা : ৪. বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় মহিলাকমিটির সদস্য মানজানা চৈতী পপি। গত ২৭ জুলাই হরতাল পালন করতে গিয়ে তিনি আইন্তশৃঙ্খলা     বাহিনীর নির্মম পিটুনির শিকার হন। তিনি সেদিনের ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেনআইনের রক্ষক হয়ে তারা সেদিন যা ইচ্ছা তা-ই করেছে। তাদের লাঠি ও বুটের আঘাতে আমি মাটিতে পড়ে গিয়েছিলাম। একজন কর্মীর সাহায্যে আব্বাস ভাইয়ের (মির্জা আব্বাসের) বাড়িতে প্রবেশ করার পরও তারা আমাকে পেটাতে থাকে। মেরুদণ্ড থেকে শুরু করে পা পর্যন্ত অনবরত আঘাত করতে থাকে। একপর্যায়ে আমি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ি।
তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. মাজহারুল ইসলামের চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তার মেরুদণ্ডের ৮টি হাড্ডিতে ফাটল ধরেছে। (বাংলাদেশ প্রতিদিন২০ আগস্টপৃ. ১)
সবশেষে একটি উন্নত রাষ্ট্রের একটি সংবাদ উল্লেখ করে নিবন্ধটি শেষ করছি।
ঘটনা : ৫. ২৮ বছর বয়সী জার্মান পপতারকা নাদিয়া বেলাইসিয়াকে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর! তা এই যেসে তার শয্যাসঙ্গীর দেহে এইচআইভি ভাইরাস সংক্রমিত করেছে! নাদিয়া পূর্ব থেকেই এইডস আক্রান্ত ছিল। অথচ এ বিষয়ে সঙ্গীকে সাবধান করেনি। এজন্য জার্মানির একটি আদালতে তাকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছে। নাদিয়া তার কৃতকর্মের জন্য আদালতে দুঃখ প্রকাশ করেছে। অপরাধী মনে করলে আদালত তাকে ৬ মাস থেকে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দিতে পারবে। (বাংলাদেশ প্রতিদিন১৮ আগস্ট)
সংবাদটির সারকথা কী দাঁড়ালএকজন পুরুষ এইচআইভি ভাইরাস বহনকারী একজন নারীর সঙ্গে অবৈধ মেলামেশায় লিপ্ত হয়ে এইডসে আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু এর দায় তার নিজের নয়ঐ নারীর! উপরন্তু ঐ নারীকেও আদালতে দাঁড়িয়ে দুঃখ প্রকাশ করতে হয়েছে। তার এটুকু বলারও অধিকার নেই যেঐ পুরুষটিকে জিজ্ঞাসা করুনকেন সে আমার সঙ্গ গ্রহণ করেছেসে কেবল সঙ্গসুখ উপভোগ করবেকিন্তু দায় ও ঝুঁকি গ্রহণ করবে না এ কেমন বিচারসম্ভবত নারীটি সচেতনভাবে কিংবা হয়তো অবচেতন মনে এ কথা জানে যেসে কেবল ভোগের পণ্য। আর পণ্যের কারণে ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সে তো অপরাধই বটে!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন