মাতৃহৃদয় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বিস্ময়কর সৃষ্টি। সন্তানের জন্য মায়ের হৃদয়ে মমতার যে ঝর্ণাধারা বয়ে যায় তার তুলনা পৃথিবীতে নেই। মা তাঁর সকল সুখ সন্তানের জন্য বিসর্জন দেন। সন্তানের চাঁদমুখ তার সকল যাতনার অবসান ঘটায়। মা নিজেকে ভুলে সন্তানের জন্য ব্যাকুল থাকেন। মায়ের মমতা পৃথিবীর এক পরম সত্যি। তবে একটি চরম বাস্তব এই যে, শুধু মায়ের মমতা সন্তানের ভবিষ্যত-কল্যাণের পক্ষে যথেষ্ট নয়। আল্লাহ মাকে মমতাময়ী করেছেন, স্বয়ংসম্পূর্ণ করেননি। সব কিছু সত্ত্বেও মা একজন মানুষ। তাই সকল মানবীয় সীমাবদ্ধতার মাঝেই তাঁর অবস্থান। মা সন্তানের জন্য কল্যাণ চাইতে পারেন, কল্যাণ দান করতে পারেন না। সকল কল্যাণের মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। তাই মমতাময়ী মা তখনই কল্যাণময়ী হন যখন তাঁর মমতাকেও তিনি অনুগত করেন রাব্বুল আলামীনের। দুই. সন্তান মায়ের কাছেই গ্রহণ করে জীবনের প্রথম পাঠ। মায়ের ভাষাতেই শিশুর মুখে বোল ফোটে এবং পৃথিবীর সাথে পরিচয় ঘটে। মায়ের আচরণ থেকে সে জীবন-যাপনের নিয়ম শেখে। তাই বলা যায়, শিশু তার মায়ের কর্ম ও চেতনার দর্পন। তাই সন্তান যখন উত্তম স্বভাব-চরিত্রের অধিকারী হয় তখন মায়ের অবদান ভোলা যায় না। পক্ষান্তরে সে যখন ভুল পথে চলে তখনও মা এর দায় এড়াতে পারেন না। কারণ মায়ের সান্নিধ্যই শিশুর ভবিষ্যত চলার পথ নির্ধারণ করেছে। কিছু বেদনাদায়ক দৃষ্টান্ত মনে পড়ছে। আমাদের পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে দুটি শিশু খেলা করত। ওরা ছিল ভাই বোন। ছেলেটির পোশাক স্বাভাবিক, কিন্তু মেয়েটির পোশাক দেখে খুব কষ্ট হত। ছোট ছোট হাতা-কাটা জামা, বুকের অর্ধেক থেকে উরু পর্যন্ত, মাঝে মাঝে দেখা যেত পিঠের মাঝেও গোল করে কাটা। সবচেয়ে কষ্টকর ছিল শিশুটির অঙ্গভঙ্গি। ছাদে বিভিন্ন বয়সী ছেলেরা খেলতে আসত। সবার মনোযোগ থাকত মেয়েটির প্রতি। আরেকটি মেয়ের কথা মনে পড়ছে। ওকে এমন একটি জামা পরানো হত, যা শিশুদের পোশাক হিসেবে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। খেলার সাথীরা এলে ও খুব লজ্জা পেত এবং দুই হাত দিয়ে জামার ওপরের অংশটা ঢেকে রাখত। ওর মা জোর করতেন জামাটা পরার জন্য। কিন্তু সে কোনোভাবেই লজ্জা কাটিয়ে উঠতে পারত না। শেষে জামাটি ওদের কাজের মেয়েকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অনেক বাবা-মা ১০-১২ বছরের মেয়েকেও হাফপ্যান্ট পরান। বলেন যে, এখনো বয়স কম। বড় হলে পাজামা পরবে। মায়ের কাছে সন্তান তো কখনো বড় হয় না। এটা মায়ের আবেগ, মাতৃহৃদয়ের অনুভূতি। কিন্তু যাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় আছে, তারা তো শুধু হৃদয়ের অনুভূতি দ্বারা পরিচালিত হতে পারে না। সন্তানের কল্যাণের স্বার্থেই তাদেরকে বিসর্জন দিতে হয় নিজের ইচ্ছা ও আবেগ। আমরা অনেকেই ভাবি, বড় হয়ে তো আমার মেয়ে পর্দা করবেই, এখন একটু ‘ফ্যাশনেবল’ পোশাক পরুক। আমার মেয়েটি কত সুন্দর, কেমন স্বাস্থ্যবতী, সবাই একটু দেখুক! কদিন পর মেয়ে আমার চলে যাবে পরের সংসারে, তখন তো স্বাধীনতা বলে তার কিছুই থাকবে না। এখন একটু আনন্দ করুক। কিন্তু এই ভাবাবেগ যে কলিজার টুকরা সন্তানকে কত বড় বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে তা কি আমরা চিন্তা করি? আল্লাহ না করুন-সন্তান যদি চলে যায় জাহান্নামের পথে, তার নির্মল চরিত্রে যদি লাগে আবিলতার ছাপ, তাহলে মা কোন প্রাণে তা সইবেন? মা তো জনমদুঃখিনী, সন্তানের কল্যাণের জন্য তাকে বিসর্জন দিতে হয় সব, এমনকি মমতার সুখটুকুও! তিন. কিছু ভালো দৃষ্টান্তও আছে। আমি একজন মাকে জানি, যিনি খুব সাধারণ একজন মানুষ। কিন্তু একটি বিষয়ে তিনি ছিলেন অনমনীয়। হয়তো খুবই সাধারণ বিষয়, কিন্তু তাঁর কাছে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তা হচ্ছে, তিনি কখনো মেয়েদের একা একা বেড়াতে পাঠাতেন না। নিজে সঙ্গে না গেলে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় তাদের থাকতে দিতেন না। এমনিভাবে কোনো আত্মীয়ের উপর নির্ভর করে মেয়েদের ঘরে রেখে কখনো বাইরে যেতেন না। অনেকের কাছেই এটা বাড়াবাড়ি মনে হত। আপনজনদের সাথে এ নিয়ে মনোমালিন্য হত, এমনকি কন্যারাও কখনো কখনো বিরক্ত হত। কিন্তু তিনি এর ব্যতিক্রম কখনো করতেন না। আজ জীবনের কিছুটা পথ পাড়ি দিয়ে আসার পর বুঝতে কষ্ট হয় না যে, কেন তিনি এমন করতেন। তাই যাদের মাথার উপর আল্লাহ তাআলা দ্বীনদার পিতামাতার ছায়া রেখেছেন তাদের কর্তব্য, পিতামাতার প্রতি আস্থাশীল থাকা এবং বিনা বাক্যব্যয়ে তাদের আদেশ পালন করা। এর সুফল একদিন না একদিন অবশ্যই বুঝে আসবে। সেদিন পিতামাতার ঐ ‘বাড়াবাড়ি’গুলোই পরম অনুগ্রহ বলে মনে হবে এবং আপ্লুত হৃদয়ে বলতে ইচ্ছ হবে-রাব্বিরহামহুমা কামা রাব্বায়ানী ছগীরা
সন্তান যে কলিজার টুকরা তাই ...
বেশ কিছুদিন আগের কথা। আমরা যে বাসায় থাকি তার দ্বিতীয় তলায় একটি অনুষ্ঠান ছিল। ওই বাসার ভদ্রমহিলা বেশ অমায়িক। তিনি আমার বাচ্চাদের আদর করেন, ওরাও তাঁকে নানু বলে ডাকে। তাই তাঁর অনুরোধে অল্প সময়ের জন্য গিয়েছিলাম। অতিথিদের অনেকে পরিচিত। তাদের মধ্যে বরের মামীও ছিলেন। কনের পারিবারিক অবস্থা নিয়ে কথা উঠতেই তিনি বললেন, ‘ওরা খুব মডার্ন। ছেলের পরিবারের সাথে বনবে না। আর ভাই, অন্যের কথা বলছি কেন? আমি নিজেও কি সুখে আছি? এদের সঙ্গে কত কষ্টে ম্যানেজ করে চলেছি! সবাই কি তা পারে?’ আমি বললাম, ‘কী অসুবিধায় পড়েছিলেন, যা ম্যানেজ করতে কষ্ট হয়েছে?’ তিনি বললেন, ‘আমাদের ফ্যামিলিতে দাড়ি-টুপি এবং নেকাব-বোরকার চল নেই। আমার স্বামী অবশ্য আধুনিক, কিন্তু শ্বশুরবাড়ির লোকজন ধার্মিক টাইপের। জানেন, বিয়ের পার্টিতে পর্যন্ত বোরকা পরে যেতে হয়েছে আমাকে! (বোরকা মানে মুখ-খোলা ‘আধুনিক’ বোরকা)। তাই বলছিলাম, ওদের কালচার আমাদের সঙ্গে মেলে না।’ এরপর আর তার সঙ্গে আলাপ জমেনি। তিনিও অন্য দিকে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আমিও বাসায় চলে এলাম। কিন্তু তার কথাগুলো ভুলতে পারিনি। দুই. কিছু দিন পরের ঘটনা। ঢাকা শহরেরই একটি মধ্যবিত্ত পরিবার। ‘আধুনিক’ এবং ‘শিক্ষিত’। পরিবারের বড় ছেলে ভালো উপার্জন করে। দুই মেয়ের ভালো জায়গায় বিয়ে হয়েছে। শুধু ছোট ছেলেটিকে নিয়ে সমস্যা। সেও উচ্চ শিক্ষিত, তবে বেকার। তাই বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া এবং ফেসবুক-ইন্টারনেটে সময় কাটানো ছাড়া আর যে কাজটি তাকে করতে হত তা হচ্ছে চাকুরি খোঁজা। কিন্তু বহু জায়গায় ধর্ণা দিয়েও যখন চাকরি হল না তখন তার মাথায় চাপল যে, বিদেশে যাবে। কিন্তু টাকা পাবে কোথায়? নিজেরও উপার্জন নেই, আত্মীয়-স্বজনও বেকার যুবককে বিশ্বাস করে না। টাকা চাইলে বাসা থেকে বলা হয়, তোমার উপর ভরসা করা যায় না। শেষে কোনো দিকে আশার আলো দেখতে না পেয়ে ছেলেটি চরম সিদ্ধান্ত নিল। ঘুমের বড়ি খেয়ে সে আত্মহত্যা করল। তিন. ছেলেটি আমার পূর্ব-পরিচিতা ঐ মহিলার ছোট ভাই, যিনি বলেছিলেন, ধার্মিক মানুষের সাথে তাদের মেলে না। ছেলেটিকে আজিমপুর কবরস্তানে দাফন করা হল। সবাই চিন্তিত, আত্মহত্যা করে যে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে তার স্থান কোথায় হবে! একপর্যায়ে জানা গেল, ওর কবরের পাশেই একজন হাফেযে কুরআনের কবর। যে ভদ্র মহিলা আমাকে পুরো ঘটনাটা শুনিয়েছেন, এখানে এসে তার চোখের তারায় আমি দেখতে পেলাম একটুখানি আশার আলো। কিন' এতে আনন্দিত হতে পারিনি; বরং খুব কষ্ট হয়েছে। আহা! কবরের জীবন সম্পর্কে যার এত উৎকণ্ঠা, সামান্য খরকুটো অবলম্বন করেও যার এমন বাঁচার আকুতি সে কেন সময় থাকতে নিজেকে শোধরায় না? কেন আখেরাতের অনন্ত জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেয় না? ওরা যদি নাস্তিক হত তাহলে কোনো কথা ছিল না, কিন্তু যাদের অন্তরে আছে ঈমানের বীজ, তারা কেন চলে উল্টো পথে, যার সমাপ্তি কুফর ও নাস্তিকতায়? চার. আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থা ও সমাজ-ব্যবস্থার এ এক চরম দৈন্য যে, তা আমাদের না দেয় দুনিয়ায় শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি, না আখিরাতের মুক্তি ও সফলতার নিশ্চয়তা। তবু কেন আমাদের মোহ কাটে না? এখন তো প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই চোখে পড়ে হত্যা, ও আত্মহত্যার খবর,। চোখে পড়ে স্কুলগামী ছোট ছোট মেয়েদের নির্যাতিতি হওয়ার সংবাদ। আমরা আসলে কীসের অপেক্ষায় এমন স্থবির হয়ে রয়েছি? এই নির্জীবতার সত্যিই কোনো তুলনা নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন